বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বদলে যায়

ফেসবুকের একটা ছবি খুব মনযোগ দিয়ে দেখছিলাম। ছবিটি আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ছবিটি খুবই সাধারণ একটি ছবি যা কোন মান সম্পন্ন ক্যামেরা দিয়ে তোলা নয়। আবার কোন দক্ষ ক্যামেরাম্যানও ছবিটি তোলেন নি।
আমার ফ্রেন্ড লিষ্টে থাকা এক ফেসবুক ব্যবহারকারী তার টাইম লাইনে ছবিটি পোস্ট করেছিলনে। সম্ভবত স্মার্ট ফোন দিয়ে উনি ছবিটি তুলেছিলেন।
যাহোক, আমি যে কারণে ছবিটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তা হলো স্কুলগামী এক দল ছাত্রী।
স্কুলগামী বয়সের মেয়েরা হাসি খুশীই থাকে, হাসি খুশী থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ চিন্তিত হওয়ার মত কোন চিন্তা তাদের করতে হয় না।
সম্ভবত ছবির এই মেয়েগুলোও হাসি খুশীই ছিল এবং এক সংগে যখন স্কুলে যাচ্ছিল তখন হয়তো অনেক মজাও করছিল। কিন্তু ছোট্র একটা নদী বা খাল পার হওয়ার জন্য যখন তারা একটা কাঠ বা বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে হাঁটছিল তখর তাদের খুবই বিষন্ন ও ভীত সন্ত্রস্ত মনে হচ্ছিল।
সম্ভবত তাদের বিষন্নতা ও ভয়ের পেছনে যে কারণটি ছিল তা হচ্ছে নড়বড়ে এই সাঁকোটি ভেংগে নীচে পরে যেতে পারে এই আশংকা ও দুশ্চিন্তা।
আমি এই সব অল্প বয়সের মেয়েদের সব সময় পছন্দ ও ভালবাসি। যেখানে যখনই এইসব মেয়েদের দেখি তখনই মনের মধ্যে এক ধরণের স্নেহ ও মমতা অনুভব করি। এর কারণ আমার একমাত্র মেয়ে ওদের মতই। আর এদের দিকে তাকালেই আমার মেয়ের মুখটি দেখতে পাই। আমার মেয়ের মুখটি যেন এদের মুখেই প্রতিফলিত হচ্ছে! এই একটা কারণে ওদের বিষন্ন মুখ দেখে আমি নিজেও বিষন্ন হয়ে গেলাম।
নিজে নিজের কাছেই প্রশ্ন করলাম-আর কতদিন, কতবার এই সব মেয়েরা আনন্দ হারিয়ে ফেলবে, মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যাবে আর বিষন্নতায় ম্লান হয়ে যাবে ওদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ?
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে আমাকে বিশ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে হয়েছিল। অর্থাৎ সেই দিনগুলোতে যা আমি আমার গ্রামে কাটিয়েছি।
শুধু আমার গ্রামেই নয় পুরো ওই এলাকাটাই আধুনিক সব ধরণের সুযোগ সুবিধা যেমন বিদ্যুৎ, রাস্তা ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ও বঞ্জিত ছিল।
প্রাইমারী ও হাইস্কুল আমাদের গ্রামেই ছিল। তবু বিশেষকরে বর্ষার দিনগুলোতে এক হাঁটু পানি আর আঠাল কাদার মধ্য দিয়েই যাওয়া আসা করতে হত।
রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল অন্য গাড়ি ঘোড়ার কথা তো বাদই দিলাম বাইসাইকেলও চালানো সম্ভব ছিল না। মাত্র কয়েকটা পাসপোর্ট সাইজের ছবির জন্য ১৫ মাইল পথ হেঁটে একটা ফটো স্টুডিওতে যেতে হত।
কিন্তু এখন এই কয়েক বছরের ব্যবধানে পুরো এলাকা জুরে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
বিদ্যুৎ এসেছে, রাস্তা ঘাট পাকা হয়েছে, বাইসাইকেলের স্থলে এখন মোটর চালিত বিভিন্ন রকমের যান বাহন চলাচল করে।
একটি পূর্ণাংগ ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একাধিক বেসরকারী ব্যাংক শাখা অফিস খুলেছে। সরকারী স্বাস্থ্য ক্লিনিক থেকে লোকেরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে, স্থানীয় হাট বাজার থেকে কেনা কাটা, ব্যবসা বানিজ্যও করতে পারছে। একটা শাখা পোষ্ট অফিসও আছে। বেশ কয়েকটা এন জি ও প্রতিষ্ঠান শাখা অফিস খুলে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বাস্তবে সেই গ্রাম এখন যেন ছোট একটা শহরে পরিণত হয়েছে।
এটা বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতা সময়ের আবর্তে নানাবিধ পরিবর্তনের মাধ্যমেই এসেছে।
আমি বিশ্বাস করি এই বাস্তবতা ওই জায়গাতেও দেখা দেবে এমন কি ওই কাঠের না কি বাঁশের সাঁকোরও পরিবর্তন হবে।
এ জন্য কিছু সময় লাগতে পারে। দুই বছর, তিন বছর বা পাঁচ বছর। কিন্তু আমি নিশ্চিত একদিন ওই নড়বড়ে সাঁকো থাকবে না। পরিবর্তে ওখানে অত্যাধুনিক কোন সেতু নির্মিত হবে।
এমনও হতে পারে এই মেয়েরাই সেদিন নির্ভয়ে আনন্দে নিজের গাড়ি চালিয়ে ওই সেতুর উপর দিয়ে ছুটে যাবে।
এটা স্বপ্ন নয় বাস্তব। কারণ ঘন্টায় ঘন্টায় সব জায়গায় সবকিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে।
সময় বদলা্য়, প্রকৃতি বদলায়। বদলায় না কি? মানুষের জীবন বদলায়, ভালবাসা বদলে যেয়ে ঘৃনায় পরিণত হয় আবার ঘৃনা ভালবাসায়।
এক কথায় বলা যায় সময়ের আবতের্ সবকিছু বদলে যায়।


সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বগুড়া আকবরিয়া গ্র্রান্ড হেটেলের মানবতা
লেখক
আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেল, বগুড়া
-কে সি মিলান
আমার কাছে মানুষের সেবা করাই মানবতা। অসংখ্য শব্দের গাঁথুনিতে যেমন এই মনবতার বিষয়টিকে দীঘর্ আকারে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে আবার মাত্র দুটি বাক্য দিয়েও এর প্রকৃত অর্থ কি তা বলা যেতে পারে। যেমন:
১. অন্যদের যখন সহায্যের প্রয়োজন সেই সময় নিজ স্বার্থ ভুলে যেয়ে অন্যদের সাহায্য করা।
২. পৃথিবীতে যত প্রাণ ও প্রাণী আছে তাদের প্রত্যেককে নিঃশর্তভাবে ভালবাসা।

সমগ্র মাানবজাতির ও পৃথিবীর কল্যাণের জন্য মানবতা একটি অত্যাবশ্কীয় উপাদান। কিন্তু বাস্তবে মানবতা খুব বেশি দেখা যায় না। অনেকটা বিরলই বলা যেতে পারে। তবে বিরল হলেও মানবতা বিরাজমান। সংখ্যায় খুব কম হলেও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এই মানবতার বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ মানবিক কর্মকান্ড হচ্ছে তা দেখা যায়।

মানুষ মানবতার বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ বিভিন্নভাবে মহৎ মহৎ কাজ করতে পারে। আর তা করতে পারে ব্যক্তিগতভাবে অথবা দলগতভাবে অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও করতে পারে।
বগুড়ার প্র্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেল সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলোরই একটি যা বিগত বহু বছর ধরে মানুষ ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত আছে।
প্রতিদিন সুস্বাদু খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি রাত্রি যাপনের জন্য হোটেলটির আবাসিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে উচ্চ মান সম্পন্ন থাকার ব্যবস্থাও।
হোটেলটির তৈরি ফাস্ট ফুডের খাবারগুলোও খুবই স্বাস্থ্যকর, সুস্বাদু যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
তবে হেটেলটির বিশেষ চমৎকার দিকটি হচ্ছে মানবতার জন্য ভালবাসা ও মানুষের জন্য কাজ করা যা নিঃসন্দেহে মানবতা বলা যেতে পারে।
মানবতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আকরিয়া গ্রান্ড হোটেল প্রতি রাতে ১০০ জনেরও বেশি ক্ষুধার্ত মানুষকে বিনা মূল্যে খাইয়ে থাকে।
হোটেলটি থানা রোডের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। যদি কেউ এই পথ ধরে এগিয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবে শহরের ভিক্ষুকেরা, ক্ষুধার্ত নারী পুরুষ ও শিশুরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
১২টা বাজার সাথে সাথে দেখা যাবে হোটেল কর্মচারীরা বড় বড় হাঁড়ি পাতিল নিয়ে বেড়িয়ে এসে এই সব ক্ষুধার্ত মানুষদের থালা বাটিতে গরম গরম ভাত, ডাল, সব্জি, মাছ অথবা মাংস পরিবেশন করতে শুরু করেছে।
আমার বিশ্বাস যে কেউ হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এই দৃশ্যটি দেখবে অন্তত মনে মনে বলবে সত্যিই এটি খুবই ভাল কাজ, খুবই মহৎ কাজ। দেশের যত সব বিত্তবান লোক রয়েছে, সমিতি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদেরও উচিৎ এই মহৎ কাজটি করা।

সন্ত্রাসীদের ভবিষ্যৎ

লেখক
- কে সি মিলান
এক ধাপ হলেও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে উন্নতি সাধন করেছে তা হলো মোবাইল স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার।
মাত্র ছয়/সাত বছর আগেও গ্রামের মানুষেরা ভাবতেও পারে নি যে তারা একটি মোবাইল ফোনের মালিক হবে আর তা ব্যবহার করে দূরের কারও সাথে কথা বলবে।
কিন্তু এই ছয়/সাত বছরের মধ্যেইে এখন বাস্তবতা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে গ্রামে গঞ্জেও এমন কোন লোক পাওয়া খুবই দূষ্কর যার হাতে মোবাইল ফোন নেই।
গ্রামের অনেক লোকই আজকাল এতটাই ভাগ্যবান যে তারা শুধু সাধারণ ফোন নয় স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে ইন্টারনেটের নানাবিধ সুবিধা ভোগ করছে।
শহুরে মানুষদের মত গ্র্রামের মানুষেরাও ফেসবুক ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে এবং তারা প্রধানত যোগাযোগ, তথ্য সংগ্রহ ও মজা পাওয়ার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করে।
আমি ফেসবুক প্রেমিক নই। তবে আমার ফেসবুক একাউন্ট আছে। আর অনেক আগে ছেড়ে আসা জন্ম গ্রহণ করা আমার প্রিয় গ্রাম ও এর আশে পাশে কি হচ্ছে, কি ঘটছে তা জানার জন্য মাঝে মধ্যে ফেসবুকে ঢুঁ মারি।
একদিন দেখলাম ইউনুছ, ইউনুছ আলী ওর টাইম লাইনে ছোট্ট একটা ভিডিও আপলোড করেছে।
আমার ঘনিষ্টজনদের একজন হচ্ছে এই ইউনুছ আলী। ও গ্রামেই থাকে আর গ্রামের হাইস্কুলে দপ্তরীর চাকরি করে।
শিরোনাম হিসেবে লেখা ছিল ‘বাঁশো মাধ্যমিক বিদ্যালয়।’ আর তা দেখেই আমি ভিডিওটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। সময় নষ্ট না করে সেই মূহুতের্ই ক্লিক করে ভিডিওটি দেখতে লাগলাম।


ভিডিওটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। শেষ হয়ে গেল দ্রুত। কিন্তু আমার মনের মধ্যে দারুন এক ছাপ ফেলে গেল। আমার মনে হলো প্রধানত তিনভাবে ভিডিওটি আমাকে প্রভাবান্বিত করেছে।
১. আমি অবাক হয়েছিলাম
২. আমার মধ্যে নতুন এক প্রত্যাশার সঞ্জার করেছিল
৩. নতুন ভাবনায় ভাবিয়ে তুলেছিল।
আমি চিন্তাও করতে পারি নি বাঁশো হাইস্কুলের মত গ্রামের একটি স্কুল সন্ত্র্রাসের বিরুদ্ধে কখনো রুখে দাঁড়াতে পরে। কিন্তু বাস্তবে এটাই হয়েছে। আর সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃনা প্রকাশ করে ছাত্র-ছাত্রী বিশেষকরে ছাত্রীদের প্রতিবাদ করা আমার কাছে এমন একটি বিষয় ছিল যা দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারি নি।
সমাজে সবকিছু সঠিকভাবে চলছে না। বিশেষকরে অন্যায়, অবিচার ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কোন প্রতিবাদ নেই বলে তা স্কুলসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শক্ত গভীর শেকর গেঁড়ে বসছে।
এ ধরণের প্রতিবাদ প্রদর্শন সত্যিই এমন আশা করতে উৎসাহ জাগায় যে অন্যায়, অবিচার দূর হয়ে সমাজের সর্বত্র ন্যায় ও বিচারের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

সম্প্রতি অন্যায়, অবিচার ছাড়াও কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা হিসেবে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। সন্দেহ নেই যে অতিতের সব সময়ের চেয়ে বর্তমানে তথাকথিত সন্ত্রাসীরা অনেক বেশী মরিয়া ও তৎপর। তবে ভাল দিকটি হচ্ছে সরকার এ বিষয়ে সজাগ হয়েছে এবং সন্ত্রাস বিরুধী ও সন্ত্রাসীদের নির্মূলে অভিযান শুরু করেছে। কি্ন্তু অভিযান প্রধানত শহর কেন্দ্রিক বলে দেশের অনেক সচেতন নাগরিক ভাবতে শুরু করেছেন যে সন্ত্রাসীরা হয়তো এবার গ্রামের দিকে যাবে এবং গ্রামের মানুষদের সাথে মিলে মিশে নিজেদের আড়াল করে ভবিষ্যৎ এর জন্য তাদের অস্তিত্ব জিঁইয়ে রাখবে।
এভাবে যারা চিন্তা ভাবনা করেন আমি তাদেরই একজন ছিলাম। তবে এখন হয়তো আমি আর তাদের দলে নেই। কারণ আমি এখন অন্য রকমভাবে ভাবতে শুরু করেছি।
ভিডিওটি দেখার পর আমি মনে করি গ্রাম পর্যায় থেকে যদি এ ধরনের প্রতিবাদ প্রদর্শন অব্যাহত থাকে আর গ্রামের মানুষেরা একত্র হয়ে তাতে যোগ দেয় তাহলে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের ভবিষ্যৎ বলে এ দেশে আর কোন কিছুই থাকবে না।


রিমি ঘোড়াঘাটের পথে

 লেখক
-কে সি মিলান
গন্তব্য মানেই দূরের কোন ঠিকান। এই ঠিকনাটি বড়ই প্রত্যাশিত যেখানে সবাই কোন না কোন দিন যেতে চায়, যেতে হয়।
সেদিন স্থানীয় এক বাস স্ট্যান্ডে অসংখ্য মানুষের ভীড় দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বেশ মনে পড়ে বিষয়টা বুঝে উঠতে কিছুটা সময় নিয়েছিলাম। অবশ্য একটু পরই বুঝেছিলাম ওই লোকেরা ছিল যাত্রী। তারা সবাই স্ব স্ব গন্তব্যগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমি যে সময় এই মানুষদের অপেক্ষা করতে দেখেছিলাম তখন সময়টা ছিল রাত পৌনে এগারটা। অর্থাৎ সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই। আর মনে হচ্ছিল সারা বিশ্বটাই যেন অন্ধকারের অতল কোন গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
গ্রীষ্মের রাত। শরীরে জ্বালা ধরবার মত চারদিকে প্রচন্ড গরম যদিও টিপ টিপ করে অনর্গল বৃষ্টি হচ্ছিল সে সময়।

বাস কাউন্টারগুলো আকারে ছোট, বসবার আসনও হাতে গোণা কয়েকটা করে মাত্র যা আগেই পরিপূর্ণ হয়ে তিল ধরতে পারে অবশিষ্ট এমন জায়গাও ছিল না। ফলে অধিকাংশ মানুষদের রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল।
কিন্তু গন্তব্যে যাবার প্রয়োজনীয়তা বা আকাংখার কাছে বৃষ্টিতে ভেজার মত সামান্য সমস্যা কোন সমস্যাই ছিল না। আর এজন্যই ভিজে ভিজেই তারা তাদের বাসের অপেক্ষা করছিল।
আমি কিছুটা ভাগ্যবান ছিলাম এজন্য যে আমি সেদিন তাদের একজন ছিলাম না।
ঘরে যেয়ে বিশ্রাম নেয়া বা ঘুমিয়ে যাওয়াই ভাল ভেবে সামনের দিকে এগুতে থাকলাম। কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছি মাত্র ঠিক তখনই রিমির দেখা পেলাম। ব্যাপারটা ছিল অবাক হবার মতেই।
সাম্প্রতিক সময়ে যাদের সংগে আমার পরিচয় হয়েছে রিমি হচ্ছে তাদেরই একজন। ওর সম্পকের্ বেশি কিছু জানিও না। শুধু জানতাম কিছুদিন আগে ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষ করে চাকরির সন্ধান করছে।
কথা বলে জানলাম একটা চাকরি পেয়েছে ও। সরকারী চাকরি। উপজেলার শিক্ষা অফিসে কর্মকর্তা পর্যায়ের চাকরি। কর্মস্থল হয়েছে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায়। চাকরিতে যোগ দেয়ার জন্য সেখানেই যাচ্ছে রিমি।
কিন্তু এত রাতে  কি একা যাচ্ছে না কি সংগে আছে কেউ? একা একজন মেয়ের পক্ষে এভাবে রাতে চলা কি নিরাপদ হবে ওর জন্য? কেন জানি এরকম কিছু উদ্ভট অনাহুত প্রশ্ন উঁকি ঝুকি মারছিল আমার মনের কোণে। লজ্জ্বাও পাচ্ছিলাম। তবে এরকম প্রশ্নের মূলে যে একেবারে কোন কারণ নেই তাও নয়।
দেশে সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়? সকাল হলেই তো খবরের কাগজে, টিভিতে, রেডিওতে দেখা যায়, শোনা যায় দরজার বাইরে পা রাখলেই মেয়েরা ধষির্ত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, নিহত হচ্ছে, নিখোঁজ হচ্ছে।
যাহোক, এক সময় আমি প্রশ্ন করেই বসলাম-কে যাচ্ছে তোমার সংগে?
কেউ না, আমি একাই যাচ্ছি রিমি সাথে সাথেই উত্তর দিল।
তোমার কি মনে হয় না পথে কোন বিপদ হতে পারে আমি আবরও প্রশ্ন করলাম।
রিমি উত্তর দিয়ে বল্ল, বিপদ হতে পারে না বা হবে না তা তো আমরা বলতে পারি না। তবে এবারে কোন বিপদ হবে না তা বলতে পারি। কারণ সারা রাত যাত্রা শেষে বাস গন্তব্যে পৌঁছাবে সকাল বেলায়।
আমি আমার রুমে ফিরে এলাম। ভীষন ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করে ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু ঘুম এল না। রিমির কথা বার বার মনে পড়ছিল।
দেওয়ালে ঝুলানো ফ্রেমে বাঁধা কোন ছবি আমার রুমে নেই। অথচ কোন এক অন্তর্দৃষ্টিতে এরকমই ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবি দেখতে পেলাম যেখানে শুধু রিমিই নয় রিমির মত অসংখ্য মেয়েরা এখন, রাতের এই অন্ধকারে জীবনের বিভিন্ন পথে এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু ভাবছিলাম আরও অনেক কিছু।
ভাবনার মধ্য দিয়ে কখন কতটা সময় যে পাড় হয়ে গেছে মনে নেই। তবে কাছের এক মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযানের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম ভোর হয়ে গেছে। একটু পরই হবে সকাল।
রিমির কথা আবার মনে এলো। হয়তো এতক্ষণে অথবা একটু পরই ওর গন্তব্যে অর্থাৎ ঘোড়াঘাটে পৌঁছে যাবে।
রিমি এটাই তো বলতে চেয়েছিল-রাত থাকবে না। রাতের অন্ধকারও থাকবে না।
আসলে রাত সে যত অন্ধকারই হোক এক সময় থাকে না।